গ্লকোমার সাথে যুদ্ধ
অধ্যাপক ডা: জাকিয়া সুলতানা সহীদ : গ্লকোমা সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা, দেরীতে বিশেষজ্ঞের কাছে আসা এবং এই রোগে সুস্থ থাকার অসচেতনতাই একজন গ্লকোমা রোগীর অন্ধত্বের অন্যতম কারণ।
গ্লকোমা চোখের একটা জটিল ও মারাত্মক রোগ যা একজন মানুষকে চিরতরে অন্ধ করে দিতে পারে এটা অনেকেই জানে না। এটা সম্পর্কে যদি আমাদের স্বচ্ছ ধারনা থাকে যেমন এটা কি ধরনের রোগ, কাদের বেশী হয়, কখন হয়, উপসর্গ কি, কখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, ঔষধ ব্যবহারের চিঠি, চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তীতা ইত্যাদি তাহলে এই রোগের উপসর্গ দেখলেই আমরা গ্লকোমা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পারি। তিনিই বলে দিতে পারবেন আপনার গ্লকোমা আছে কিনা? থাকলে কি ধরনের চিকিৎসা আপনার জন্য গ্রহণযোগ্য। কারণ সব ধরনের ব্যবস্থা পত্র সবার জন্য প্রযোজ্য নয় সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই এর নীতি নির্ধারক।
একজন অন্ধ মানুষের জীবন যেমন দুর্বিষহ তেমনি অভিশাপ – একটা পরিবারের, একটা সমাজের, কিংবা একটা জাতির। গ্লকোমা মানুষের দৃষ্টিশক্তিকে কেড়ে নেয় ঠিক কিন্তু সঠিক সময়ে যদি রোগ নির্ণয় করা যায় কিংবা চিকিৎসা করা যায় তাহলে এই রোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। একজন সচেতন ব্যক্তিই পারবেন গ্লকোমায় অন্ধত্ব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। তার এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তাকে সত্বর ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে এবং দ্রুত চিকিৎসা নিতে সাহায্য করবে।
আপনি কি জানেন গ্লকোমা অন্ধত্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ? প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ সারা বিশ্বে গ্লকোমাজনিত রোগে দুই চোখে অন্ধ। গ্লকোমা রোগে ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ৭৯.৬ মিলিয়ন। এ সংখ্যা ২০৪০ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ১১১.৪ মিলিয়ন। কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশে ৯০% গ্লকোমা রোগ এখনো নির্ণয় হয় নি।
যেহেতু এই রোগ নীরব ঘাতক যার উপসর্গ বুঝা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না সেহেতু ৫০% আক্রান্ত ব্যক্তিই বুঝতে পারে না তার গ্লকোমা হয়েছে এবং ধীরে ধীরে তিনি অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন। এজন্য প্রতি বছর অন্তত একবার একজন ৩৫ বছর ঊর্ধ্ব মানুষ যদি বিশেষজ্ঞের কাছে চোখ পরীক্ষা করান তাহলে গ্লকোমা রোগে চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই তাকে প্রতিরোধ করতে পারবেন।
গণসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ওয়ার্ল্ড গ্লকোমা এসোসিয়েশন এ বছরের ৬-১২ই মার্চকে বিশ্ব গ্লকোমা সপ্তাহ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গ্লকোমা সোসাইটি এই সময় তাদের দেশে গ্লকোমার বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে। গ্লকোমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা, গ্লকোমায় আক্রান্ত রোগীকে চিহ্নিত করা , চিকিৎসা করা ই এই সপ্তাহের উদ্দেশ্য।
২০২২ সালের গ্লকোমা সপ্তাহের স্লোগান:
“ The world is bright, save your sight.
আপনার দৃষ্টি রক্ষা করুন, সুন্দর পৃথিবী উপভোগ করুন।
এ স্লোগানের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। মানুষকে বলা হচ্ছে আপনি এগিয়ে যান, গ্লকোমার জন্য চোখ পরীক্ষা করান এবং আপনার চোখকে রক্ষা করুন।
জেনে রাখুন গ্লকোমা এক ধরনের চক্ষু রোগ যা চোখের অপটিক স্নায়ুকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে এবং চোখের দৃষ্টিকে কেড়ে নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই স্নায়ু ধ্বংসের একমাত্র কারণ চোখের উচ্চচাপ, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোখের স্বাভাবিক চাপ ও চোখের অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি রোগীর চোখের চাপকে আয়ত্বের মধ্যে আনা যাবে তত তাড়াতাড়ি চোখকে গ্লকোমার হাত থেকে বাঁচানো যাবে।
সম্ভাবনাময় মানুষ যারা সচরাচর গ্লকোমায় ভুগবেন :
যাদের বয়স ৩৫-৪০ এর ঊর্ধ্বে
যাদের পরিবারে বাবা মা কিংবা নিকটতম আত্মীয় যেমন-নানা-নানী, দাদা-দাদী, খালা-ফুপু, চাচা গ্লকোমায় ভুগছেন তাদের ৩০% সম্ভাবনা গ্লকোমা হওয়ার।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চোখের মাইনাস পাওয়ার ব্যবহার করেন , মাইগ্রেন, চোখের ছানি দীর্ঘদিন অপারেশন না করা, স্টেরয়েড জাতীয় ঔষুধ ব্যবহার করা। এই রোগের ক্ষেত্রে রোগী সচরাচর যে সমস্ত উপসর্গগুলো বলে থাকেন সেগুলো হচ্ছে প্রায়শ মাথা ব্যথা ও চোখ ব্যথা, অস্বস্তির ভাব, যেই চশমা উনি পড়ছেন তাতে স্বস্তি না পাওয়া, দৃষ্টির চারিপাশে রংধনুর মত রং দেখা, স্বল্প আলোতে টি.ভি দেখা, পড়াশুনা বা সেলাই কাজ করতে গিয়ে মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা করা ও চোখ লাল হয়ে যাওয়া অথবা স্বল্প আলো ছাড়াও চোখ ব্যথা, মাথা ব্যথা ও চোখ লাল হওয়া ,বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জন্মগত বড় চোখ কিংবা জন্মের পর আস্তে আস্তে চোখ বড় হয়ে যাওয়া, চোখের মণির চারিপার্শ্বে চোখের সাদা অংশ দেখা বা মণি ঘোলাটে হয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় কথা রোগী যদি অনুভব করেন তার চোখের ব্যপ্তি বা দৃষ্টির চারিদিকের পরিসীমা আগের চাইতে অনেক ছোট হয়ে গেছে, তিনি হাঁটতে চলতে বারবার চারিপাশের জিনিসের সাথে লেগে হোচট খাচ্ছেন তখন অবশ্য অবশ্যই আপনি গ্লকোমা বিশেষজ্ঞের কাছে দেখিয়ে জেনে নিন আপনি গ্লকোমায় ভুগছেন কিনা।
গ্লকোমার কারণে যেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায় তা আর ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যতটুকু দৃষ্টিশক্তি আছে তাকে যদি আমরা চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক করতে পারি তাতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যভাবে আপনার বাকি জীবন কাটিয়ে নিতে পারবেন। যার জন্য একজন বিশেষজ্ঞের সহযোগীতা যেমন দরকার তেমনি একজন রোগীর নিয়মিত ঔষধ নেয়া, নিয়মিত ডাক্তারের কাছে চোখ দেখিয়ে নেয়া এই সহযোগীতা ও সদিচ্ছাও দরকার।
আসুন আমরা গ্লকোমাকে বরণ করে নয় গ্লকোমার সাথে যুদ্ধ করে নিজেদের জয় করে নেই।
লেখক: অধ্যাপক ডা: জাকিয়া সুলতানা সহীদ, ফ্যাকো, গ্লকোমা বিশেষজ্ঞ ও সার্জন, অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, চক্ষু বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল । প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট, বাংলাদেশ গ্লকোমা সোসাইটি।