বিভিন্ন মেডিকেলে ইন্টার্নদের ধর্মঘট অব্যাহত, রোগীদের দুর্ভোগ
কারেন্টনিউজ ডটকমডটবিডি:
রোগীর স্বজনকে মারধরের জেরে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের চারজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে প্রদান করা শাস্তি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও। দেশের বৃহত্তম চিকিৎসাসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালসহ মোট অন্তত দশটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা ইতোমধ্যেই আন্দোলনে নেমেছেন। ফলে অসংখ্য রোগী তাদের কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে বিরাজ করছে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা। এতে রোগী ও তাদের স্বজনদের অনেকেই আতঙ্কিত। আন্দোলন আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শজিমেক হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা গতকাল কর্মবিরতি পালনের পাশাপাশি হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ঢামেক হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। এ ছাড়া রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা গতকাল কর্মবিরতি পালনের পাশাপাশি বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন। উপরোল্লিখিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা শজিমেক হাসপাতালের চারজনের শাস্তি প্রত্যাহারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম বেঁধে দিয়েছেন। রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ (দিমেক) হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরাও শজিমেক হাসপাতালের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে মাঠে নেমেছেন।
সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, আন্দোলনের মধ্যেও চিকিৎসাসেবা যথাযথভাবেই চলছে। যদিও এসব হাসপাতালের অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা এই প্রতিবেদক ও আমাদের সময়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন, আন্দোলনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। কারণ একজন চিকিৎসক রোগী দেখার পর রোগীর কেস হিস্ট্রি লেখা থেকে শুরু করে তার ওষুধপথ্যাদি ও রোগসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম তদারকি করে থাকেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা। শুধু গুটিকয় চিকিৎসকের মাধ্যমে এত রোগীর তদারকি করা সম্ভব নয়। আন্দোলনের কারণে এখন হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবাপ্রার্থীদের সামাল দিতে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও কনসালট্যান্টরা হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক রোগী চিকিৎসাসেবা না পেয়ে ফেরত যাচ্ছেন।
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্রায়ান বঙ্কিম হালদার গতকাল সাংবাদিকদের জানান, বগুড়ার ঘটনায় রোববার (গতকাল) সকালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা মানববন্ধন করেছেন। শাস্তি প্রত্যাহারে তারা ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে কর্মবিরতিও পালন করছেন। এতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া আমাদের সময়কে জানান, ওই হাসপাতালটিতে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের আন্দোলন চলছে ঢিলেঢালা। জরুরি বিভাগের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা ডিউটি করছেন না। তবে এতে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমে তেমন কোনো ব্যাঘাত হচ্ছে না; চলছে স্বাভাবিকভাবেই।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল আমাদের সময়কে বলেন, শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা মূলত ট্রেইনি হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় চিকিৎসসেবা ব্যাহত হবে না। কারণ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা প্রদানে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসক আছেন। শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের আদেশ বাস্তবায়ন করেন। এ কারণে চিকিৎসাসেবায় তেমন প্রভাব পড়বে না।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের যে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। এদিকে আন্দোলনকারীরাও আমাদের কিছু জানাননি। আমরা পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছি। লক্ষ রাখছি, চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
তিনি যোগ করেন, আন্দোলনের মধ্যে কেউ যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকার না করতে পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, তারা যেন চিকিৎসাসেবায় ব্যাঘাত ঘটে, এমন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন।
সার্বিক পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে আগামী ৭ মার্চ বিএমএ-এর জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের কোনাগাতি গ্রামের আলাউদ্দিন সরকার স্ট্রোক করে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি শজিমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন। বেড না পাওয়ায় মেডিসিন বিভাগের ৪৭৫ নম্বর রুমের মেঝেতে ছিলেন তিনি। রোগীর মাথার ওপর ফ্যান চলায় তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে রোগীর ছেলে আবদুর রউফ ও কর্তব্যরত শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের মধ্যে কথা কাটাকাটির জের ধরে আবদুুর রউফকে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা মারধর করেন। আবদুর রউফের বোন বীণা ও সেতু ঘটনাটি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জানানোর কথা বললে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা ক্ষিপ্ত হয়ে আবারও আবদুর রউফ ও তার বোনদের মারধর করেন। এ ঘটনা দেখে রোগী আলাউদ্দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন তিনি মারা যান।
এরপর শাস্তির ঘোষণা আসায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা ওইদিন দুপুর থেকে পরদিন বিকাল পর্যন্ত কর্মবিরতি ঘোষণা করেন, যা এখনো চলছে। এতে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। অনেক রোগী চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সর্বশেষ তাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলনে নেমেছেন উপরোল্লিখিত আটটি হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা।
এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নির্মলেন্দু চৌধুরীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে আরও একটি কমিটি গঠন হয়। কমিটি ২৫ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন তদন্ত করে। তদন্ত শেষে কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে অভিযুক্ত চার শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মন্ত্রীকে রিপোর্ট দেন। এ রিপোর্টের ভিত্তিতে তাদের শাস্তি প্রদান করা হয়।
শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা হলেনÑ ডা. নূরজাহান বিনতে ইসলাম নাজ, ডা. আশিকুজ্জামান আসিফ, ডা. কুতুবউদ্দিন ও ডা. এমএ আল মামুন। এদের মধ্যে ডা. নাজকে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, ডা. আসিফকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, ডা. কুতুবউদ্দিনকে যশোর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং ডা. মামুনকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ শেষ করতে হবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ধর্মঘট শুরু করেন। এতে ভোগান্তিতে পড়েন হাসপাতালে আসা রোগীরা। এ ব্যাপারে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কয়েকজনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা কেউ ফোন ধরেননি। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ধর্মঘটের কারণে রোগীদের যাতে কোনো কষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে চিকিৎসকদের বলে দেওয়া হয়েছে।
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে টানা কর্মবিরতির পর গতকাল বহির্বিভাগ বন্ধ রেখে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা। এতে দুই শতাধিক রোগী চিকিৎসা না পেয়ে জরুরি বিভাগের সামনে অবস্থান করছিলেন। এ ছাড়াও আন্দোলনকারীরা মেডিক্যাল কলেজের ক্লাস এক ঘণ্টার জন্য বন্ধ রেখে মানববন্ধনে যোগ দিতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অব্যাহত রয়েছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসাসেবায় নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। গতকাল দুপুরে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএফএম রফিকুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা মৌন মিছিল ও ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। কর্মসূচি চলাকালে তারা বলেন, বগুড়া মেডিক্যালের চারজনের শাস্তি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। এদিকে কর্মবিরতির ফলে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত ও রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা হাসপাতালের সামনে মানববন্ধন করেন। এরপর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। হাসপাতালের পরিচালক ডা. অজয় কর অবশ্য জানান, রোগীদের তেমন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে না। কারণ চিকিৎসকদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে এবং তাদের বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।